Thursday, June 22, 2006

কিঞ্চিৎ ইতিহাস-চর্চা 

আমার তিন ধরণের পরিচয় আছে।  অপরিচিতের কাছে অপরিচিত, অল্প-পরিচিতের কাছে উন্নাসিক, আর অতি-পরিচিতের কাছে বাচাল। এ গল্পটি এর আগে কখনো অতি-পরিচিতের গন্ডি টপকাতে পারেনি, তাই আজো শুধুই আমার বাচালতার সাক্ষ্য বয়ে চলছে।

গল্পের স্থান-কাল-পাত্র বিচারে আমি কিঞ্চিৎ স্বাধীনতা দাবি করেছিলাম। যুদ্ধের বাজারে সেটা বেশি না কম, তা তর্কসাপেক্ষ। আমি যখন কার কথা বলছি যুদ্ধটা সবে শুরু হয় হয়। তবে এ গল্প যুদ্ধের গল্প নয়। কেউ যুদ্ধে যায়নি, বরং সবাই যুদ্ধ থেকে শত হস্ত দূরে যেতে চেয়েছিল। 

কে একজন সেদিন এসে বাইরের ঘরে বলেছিলো কলকাতাতে নাকি বোমা পড়তে পারে। অমনি হুড়দৌড় লেগে গেলো। ঠাকুরদের একটা বাড়ি ছিল পটাশগড়ে। শোরগোলটা যখন জেঁকে বসেছে, রবি বাবু পারি দিলেন পটাশগড়। তখন তিনি বেশ বিখ্যাত, কদিন আগেই সাহেবরা তাকে কিসব মস্ত পুরস্কার দিয়েছিলো। এই গল্পটা আমি প্রথম বলি তারিণীকে। ও ইতিহাসের ছাত্র আর বোকা বোকা প্রশ্নের বাতিক আছে। বলে কিনা অমন কোনো জায়গা নাকি ম্যাপে নেই। আগে গল্পটা শোন, তবে তো বুঝবি কেন ম্যাপে নেই। আর তাছাড়া মাপে কি আছে কি নেই, তাই দিয়ে কি ঠিক হয়। আমার সাথে ইস্কুলে পড়তো চিত্তব্রত, ছোটবেলাতে ভূগোল এর খাতাতে ভারতবর্ষের যে ম্যাপ এঁকেছিল তা বাইরে প্রকাশ পেলে আমাদের সাম্রাজ্যবাদী-বিরোধী তকমা তে জোর আঘাত লাগতে পারতো। যতদূর মনে পড়ে, পাকিস্তান তো বটেই, খাল কেটে চিত্ত আফগানিস্তানেও থাবা বাড়িয়ে দিয়েছিলো। তো পটাশগড় যে ম্যাপ এ নেই, তাতে আমি তেমন অবাক হয়নি। তবে ইতিহাস বই থেকে যে মুছে গেছে সেটাই দুঃখের। 

তা সে যাই হোক, পটাশগড়ের নাম কি করে পটাশগড় হলো, আমার আর আজ তা মনে নেই। সেখানে দেখবার মতো কিছুই প্রায় ছিল না। যা ছিল তা এক বিশাল জঙ্গল। নাটোরের রাজারা সেখানে শিকার করতে যেত। তাও সে অনেক লোক-লস্কর সাথে নিয়ে। নয়তো দিনের বেলাতেই যা অন্ধকার, ভেতরে ঢোকে কার সাধ্যি। ঢুকতো কেবল বঙ্কুবিহারী আর তার খানকয় পোষা ছাগল। আমার দৃঢ় বিশ্বাস বঙ্কুবাবুর আধ্মাত্যিক যোগ ছিল। সাত গাঁয়ের লোক যদিও তাকে পাগল বলেই মনে করতো। কস্মিনকালেও তার কোনো বন্ধুবান্ধব ছিল না ওই বেওয়ারিশ ছাগল কয়খানি ছাড়া। কিন্তু বঙ্কুবাবু জঙ্গলে যেতেন ঠিক ছাগল ছড়াতে নয়।  শেষ বিকেলের দিকে তিনি জঙ্গলে ঢুকে নিভৃতে হুঁকোপান করতেন। আমাকে অনেকে প্রশ্ন করেছে হুঁকোটা কোথ্থেকে এলো, বঙ্কুবাবুকে জঙ্গলেই বা যেতে হয় কেন ধূমপানের জন্য? কিন্তু এগল্প কোনো আদালতনামা নয়, ইতিহাস পরীক্ষার উত্তরপত্রও নয়, এসব প্রশ্নের উত্তর দেবার দায় অন্তত আমার নেই।

আমি যেদিনের কথা বলছি, সেদিনটা ছিল অন্যদিনের মতোই। বিকেল প্রায় শেষ হয় হয়। সময়টা শীতকাল, ঠান্ডাও পড়েছিল জাঁকিয়ে। একটি বেশ পুরোনো বটগাছের তলাতে বঙ্কুবাবু গুছিয়ে বসে হুঁকোটা টানছিলেন। আমেজটাও আসছে গভীরভাবে, কিন্তু কোথা থেকে কি যে হয়ে গেলো। সেদিন জঙ্গলে ঢুকেছিলেন বঙ্কুবাবু ছাড়াও আরো একজন, আমাদের রবীন্দ্রনাথ। হঠাৎ করে বঙ্কুবাবু দেখলেন চোখের সামনে অদ্ভুতদর্শন কি একটা যেন দাঁড়িয়ে। বঙ্কুবাবু তাকে চিনতেন কিনা জানিনা, তবে শীতের শেষ বিকেলে আলো একটু কমই ছিল। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন দীর্ঘদেহী, তার ওপর পড়েছিলেন এক বিষম কালো, বেঢপ আকৃতির জোব্বা। বঙ্কুবাবুর এতদিনের জীবনচক্রে এই দর্শন ছিল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। হাত থেকে হুঁকো খসে পড়লো, বঙ্কুবাবু বাকরহিত হয়ে গেলেন। তাকে আমি দোষ দেইনা। শেষ বিকেলের আলোআঁধারে ওই অদ্ভুতদর্শন মূর্তি আমাদেরও ভয় ধরাতে পারতো। কিন্তু এক্ষেত্রে ফল হলো ভয়াবহ। ছিলিম এর আগুন ছিটকে পড়লো এক রাশ শুকনো পাতার ওপর। জঙ্গলে এর আগেও বার দুই আগুন লেগেছিলো, কিন্তু এবারের আগুন ছিল ভয়ঙ্কর। গোটা জঙ্গল জুড়ে ছড়িয়েছিলো মরা গাছ আর শুকনো পাতা। দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগলো আগুন। এক মাস ধরে দেখা গেছিলো আগুনের শিখা, শেষ হয়ে গেছিলো পুরো জঙ্গল।    

আমি তারিণী কে বললাম বুঝলি কেন তোর ম্যাপে আজ পটাশগড় দেখা যায়না। বিধি বাম, সন্দেহ তাতেও যায় না। বলে রবিঠাকুর কেন লিখে যাননি একথা? রবিঠাকুর বললে যা বিশ্বাস করা যায়, আমি বললে তাতে যেন চোনা পরে গেছে। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু লিখে গেছিলেন এ ঘটনার কথা। ওই দাবানলের অভিজ্ঞতা তিনি ভোলেননি। একটি গান লিখেছিলেন, 
ওরে ভাই আগুন লেগেছে বনে বনে 
ডালে ডালে ফুলে ফুলে  পাতায় পাতায় রে, 
আড়ালে আড়ালে কোনে কোনে।  ...

সে গান ছাপতে গেছিলো পত্রিকায়। টাইপসেটিং এর কাজ করতেন তারাদা। তিনি কাজের মানুষ ছিলেন, কোনোদিন ফাঁকি দেননি, কেবল চোখে সামান্য যা একটু কম দেখতেন রাতের দিকে। ছাপার সময়ে একটা আগুন যে ফাগুন হয়ে গেছে, তারাদার নজর এড়িয়েছিল। পরে আমি তারাদার ছেলে রমাপদকে জিজ্ঞেস করেছিলাম এমন ভুল কি তারাদা আদৌ করতে পারেন? রমা বললো বাবার বিয়ে হয়েছিল ফাগুনে, আমার জন্মও ফাগুনে, বাবার  তো একটু ফাগুনপ্রীতি ছিল। কিন্তু ভুলটি বেশ গুরুতর। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং তা সংশোধন করতে উদ্যোগী হলেন না? আমি অনেক বইপত্তর ঘেঁটেছি, রবীন্দ্রনাথ কোথাও তা উল্লেখ করেননি। বোধ করি আগুনের স্মৃতি তাকে বিষম জ্বালাচ্ছিলো। তিনি সেটা ভুলতেই চেয়েছিলেন। সুযোগ এমন অযাচিত ভাবে এসে গেলো, তাকে অগ্রাহ্য করতে পারেননি। তবে এটা আমার ব্যাখ্যা, বলা বাহুল্য তারিনীর পছন্দ হয়নি।

আগেই বলেছি আমার এগল্প বলার অভিজ্ঞতা কখনো সুখের হয়নি। অতি-পরিচিতেরা বলতেন প্রলাপ, নতুন কিছু বলতে গেলেই সন্দেহের চোখে দেখতেন। ভাবখানা এমন আবার বাজে বকতে শুরু করেছে। কেবলমাত্র একজন সব শোনার পর একমুখ সরল বিশ্বাস নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল এসব কি সব সত্যি? এ কাহিনীর কোনো চরিত্রই তো আজ আর বেঁচে নেই, কিন্তু বিশ্বাসে মিলায়ে বস্তু। আমি এই গল্পখানি আমার সেই ছোট্ট বন্ধুটির জন্য লিখলাম।

4 Comments:

Anonymous Anonymous said...

This comment has been removed by a blog administrator.

6/23/2006 12:38 AM  
Blogger Kele Panchu said...

Ei to lekha! Darun golpo bhai, erokom aaro onek chai. Ekebare Damrudhar er moto majlisi dhong e upasthapito! Erokom aaro onek chai!

6/27/2006 12:20 PM  
Blogger Bishu said...

Panchu-r blog theke tomar blog-e elam.Besh jomati lekha...aaro chai...chaliye jao.

6/30/2006 2:05 AM  
Blogger Quietus said...

tomar blog add korechhi :)

5/07/2007 7:38 PM  

Post a Comment

<< Home